মঙ্গলবার

#নিয়তি--২(পর্ব--২) । লিখা-- আসমা আক্তার পিংকি।

 #নিয়তি--২(পর্ব--২)।

বেলা বারোটায় হঠাৎ কনিং বেলের আওয়াজ। নাজিফা রান্নাঘর থেকে--- কে??
দরজার ওপাশ থেকে মেয়েলি কন্ঠে --- জ্বি আমি?
--- আসছি একটু দাড়ান।
নাজিফা কিছুটা বিস্মিত হয়ে দরজা খুলতেই একটি ২৩ কি ২৪ বছরের তরুনী, সেলোয়ার- কামিজ,, এবং হিজাবে আবৃত, সরল মুখের অধিকারী।
---- জ্বি আসসালামু আলাইকুম,,, আপনি কে??
মেয়েটি অদ্ভুত দৃষ্টিতে নাজিফার দিকে চেয়ে --- আপনি ভারী সুন্দর তো দেখতে, এর জন্যই তো বলি ইমাদের মতো ছেলে আবার সংসারিক হলো কি করে।
--- শুকরিয়া, কিন্তু আপনাকে তো আমি চিনলাম না।
---- তুমি কিন্তু সত্যিই অনেক সুন্দর, এন্ড তোমার কন্ঠ টাও মাশাআল্লাহ।
নাজিফা ভ্রু কুঁচকে --- সবেই বুঝলাম কিন্তু কাইন্ডলি একটু বলবেন আপনি কে???
---- আমি তোমার সতীন।
নাজিফা জোর গলায়--- জ্বি!!!!! আপনি এসব কি বলছেন!!!
--- যা বলছি সত্যি আমি ইমাদের ওয়াইফ আইমিন তোমার একমাত্র সতীন।
নাজিফা গরম চোখে--- ফাজলামো করার আর কোনো জায়গায় পান না,,, লিসেন ইমাদ শুধু আমার স্বামী, আপনার মতো একশো- একটা মেয়ে ও যদি আমার সামনে এসে বলে --- তারা ইমাদের স্ত্রী,আমি কখনোই তা বিশ্বাস করবোনা।
নাজিফার কথাগুলো শুনে মেয়েটি ক্ষীণ কন্ঠে --- ভালো বাস খুব ইমাদকে তাইনা???
নাজিফা কিছু বলার আগেই সালেহা বেগম নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে জোর গলায়--- নাজিফা ওখানে দাঁড়িয়ে কার সাথে কথা বলছো???
---- মা একটা মেয়ে, চিনিনা আমি।
সালেহা ওমনেই নিচে নেমে আসতে-- আসতে --- এসময় আবার কে এলো।
দরজার সামনে যেতেই চোখে-- মুখে আনন্দ নিয়ে--- আরে মায়া তুই!!! কখন এলি আর বাইরে দাঁড়িয়ে কেন ভিতরে আয়। নাজিফাকে উদ্দেশ্যে করে--- এই হলো মায়া তোমাকে যার কথা বলেছিলাম, আমার ছোট বোনের মেয়ে।।৷
---- আসসালামু আলাইকুম,, খালা ভালো আছেন???
---- জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ,, তুই কেমন আছিস???
---- আল্লাহ তাআ'লার অশেষ করুনায় ভালো আছি।
--- সেই যে জাপানে গেলি এতোদিন পরে দেশে আসার কথা মনে পড়লো, কতবার যে তোকে দেশে আসতে বললাম একবার ও এলিনা কি খালার কথা, মায়ের কথা মনে পড়েনা নাকি??
----- না খালা আসলে কাজের এতো চাপ যে সময়ই পাইনা দেশে আসার।
এই বলে মায়া ভিতরেই ঢুকতেই নাজিফা অনুতাপের চোখে ওর দিকে চেয়ে,,, ওর হাতটা শক্ত করে ধরে--- দুঃখিত তোমাকে চিনতে পারিনি,, এবং ক্ষমা করে দিও তোমার সাথে এভাবে আচরণ করায়। আসলে ইমাদের ব্যাপার তো তাই অমন আচরণ করলাম।
মায়া তখন মুচকি হাসি দিয়ে---- খালামনি ফোনে অনেক বার বলেছিলো, তুমি অনেক ধার্মিক, পরহেজগার, এন্ড অধিক ভালো একটা মেয়ে, প্রথমে যুগের কথা ভেবে বিশ্বাস করতে পারলাম না বাট আজ সরাসরি তোমার সাথে আলাপচারিতা হয়ে বুঝতে পেরেছি খালা সত্যিই বলেছে।।
নাজিফা কিছুটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে--- মা ভুল বলেছে,,, সত্যি কথা বলতে আমি কোনো পরহেজগার কিংবা খুব ধার্মিক বা খুবেই পর্দাশীন, মেয়ে নয়,,, আমি কেবলি একজন খাঁটি মুসকমান হওয়ার চেষ্টা করি,,, আমি খাছ পর্দাশীন নারী ও নয় কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য চেষ্টা করি,, নিজেকে তার খাঁটি বান্দা করতে ব্যস এটুকুই এতে যদি কেউ আমাকে খুব ভালো ভাবে কিংবা ধার্মিক ভাবে এটা তার সবচেয়ে বড় বোকামী,,, আবার খুব খারাপ ভাবলেও এটা তার সবচেয়ে বড় ভুল চিন্তা। কেননা পৃথিবীর প্রতিটি মানুষেই খারাপ-- ভালো দুটোর সংমিশ্রণে তৈরি।
.
.
নাজিফার কথাগুলো শুনে মায়া অবাক হয়ে যায়,,, মেয়েটি সত্যি আর পাঁচটা মেয়ে থেকে আলাদা,,, ওর ভিতরে আলাদা একটা সত্তা আছে,,, সত্যিই এতোদিনে বুঝলাম ইমাদ কেন আবার সাংসারিক হলো।
----- কি মায়া দাঁড়িয়ে -- দাঁড়িয়ে শুধু ভাবীর কথাই শুনবে নাকি খালার সাথে কথা বলবে।।
---- হ্যা খালা তোমার সাথে ও অনেক কথা বলবো বাট তার আগে ফ্রেশ হয়ে নেই কিছুক্ষন পরে জোহরের আযান দিবে নামাজ পড়ে তারপর তোমার সাথে আর ভাবীর সাথে গল্প করবো।।
নাজিফা খুশী হয়ে গেলো--- যাক এতোদিন পরে এমন কাউকে তো পেলাম যার সাথে বসে দুদন্ড কথা বলা যাবে।।
.
.
.
দুপুর বেলা ইমাদ বাড়ি ঢুকে উপরের দিকে যেতেই ,,, হাসাহাসির শব্দে,,, দাঁড়িয়ে গেলো--- কে এতো হাসাহাসি করছে???
ইমাদ চারপাশের দিকে তাকিয়ে-- শব্দটা তো বসার ঘরের দিক থেকে আসছে।
ইমাদ বসার ঘরের দিকে যেতেই দেখতে পেলো --- নাজিফা, নাবা,নওরিন আর মায়া বসে-- বসে গল্প গুজব করছে।
ইমাদ অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থাকে,, হঠাৎ নওরিন দরজার দিকে তাকাতেই ---- বাবাই তুমি আসছো,, দেখো মায়া আনটি আসছে।
ইমাদকে দেখতেই মায়া দাঁড়িয়ে গেলো,,, কি অদ্ভুত সুন্দর লাগছে ছেলেটাকে , গোল্ডেন কালারের পান্জাবী পরনে আর সাদা পায়জামা টুপিতে বেশ লাগছে।
ছেলেটার এরুপ পরিবর্তন সত্যিই ভাববার বিষয়।
মায়া কিছুটা করুন সুরে--- কেমন আছিস ইমাদ??
ইমাদ শুকনো মুখে--- জ্বি আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহর অশেষ রহমতে ভালো আছি তুই????
---- আমি ও এইতো আছি।
--- তা কবে দেশে আসলি??
--- এইতো সপ্তাহ খানিক আগে।
---যাক এতেদিনে তাহলে আমাদের কথা মনে পড়লো।
ইমাদ নাজিফাকে উদ্দেশ্য করে--- মায়াকে দুপুরের খাবার দিয়েছো???
--- না আসলে ও বলেছে একসাথে সকলে মিলে বসে খাবে।
--- ও আচ্ছা তোমরা কথা বলো আমি উপরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসি।
নাজিফা তখন ইমাদের দিকে চেয়ে--- নামাজ পড়েছো???
---- হুম,, মসজিদ থেকে পড়ে তারপর আসলাম।
মায়া ইমাদের এরুপ পরিবর্তন দেখে সত্যি অবাক হয়ে যায়,, এই কি সেই ছেলেটা যে কিছুটা উগ্র মেজাজের আর নিজের মন যা চাইতো তা করতো। এখন ও মনে আছে কলেজ লাইফ, ভার্সিটি লাইফে ওর সবথেকে কাছের বন্ধু ছিলাম আমি,,, ওর সাথে আমার দীর্ঘ সুসম্পর্কের বছর গুলোতে কখনো আমি ওর পা অবদি ধরে ওকে ঠিক করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়াতে পারিনি,,, উগ্র মেজাজের কারনে কত ছেলের সাথে যে ওর মারপিট হয়েছিলো তা কেবল আমিই জানি,,, খালামনির কাছে ও বিচার দিয়েছি কতবার, শুধু ওর রাগটা কন্ট্রোল করার জন্য কিন্তু ও কখনোই পরিবর্তন হয়নি। তারপর তো ভার্সিটির সবচেয়ে স্টাইলিশ ও সুন্দরী মেয়ে মিতুর প্রেমে পড়ে গেলো,, দুজনকে বেশ লাগতো, ওদের দুজনেই পুরো ভাড়সিটিতে সবচেয়ে বেস্ট যুগল ছিলো।
আর আমি হয়তো ওকে খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছিলাম তাই ওর থেকে দূরে চলে গেলাম,,, জাপানে বাবার কাছে চলে গেলাম,,, ওকে সবজায়গায় থেকে ব্লক লিষ্টে ফেলেদিলাম। ওর সাথে সমস্ত যোগাযোগের পথ বন্ধ করে দিলাম।
তারপর তো একদিন হঠাৎ শুনলাম ওরা দুজনে নাকি বিয়ে করেছে,, , হয়তো খুব খারাপ লেগেছিলো কিন্তু মেনে নিলাম,,, কিন্তু হঠাৎ কয়েকবছর পর ইমাদের ফোন---হ্যালো মায়া।
--- আসসালামু আলাইকুম কেমন আছিস ইমাদ??
ওপাশ থেকে তখন চাপা কান্নায় ভেঙে পড়া সেই উগ্র মেজাজের ছেলেটি অনেক কষ্টের পর বললো ---- মায়া,, মিতু আর নেই।
ওর কথায় আমি বুঝে ফেলেছিলাম বড্ডো বেশি ভালোবাসতো মিতুকে।। নিজের লাইফের ব্যস্ততার কারনে তখন আর দেশে আসতে পারিনি। তারপর তো অনেকটা বছর কেটে গেলো,, ইচ্ছে ছিলো মানুষটাকে ফোন করে নিজের মনের সব কথাগুলো বলে দেবো কিন্তু সংকোচ, জড়তা আমাকে কখনোই তা বলতে দেয়নি তাইতো আবারো সে অন্য কারো হয়ে গেলো। তবে ফোনে বলতে না পারলে ও ইমেলে অনেক আকার- ইঙ্গিত দিয়ে ওকে বুঝিয়ে ছিলাম ওর সন্তান দুটোর মা হতে চাই আমি।
বাট ও আমাকে সোজাসাপ্টা বলে দিলো --- ও আর কখনোই বিয়ে করবেনা,, আর মিতুর জায়গা আর কাউকে দিতে পারবেনা,,আর ও কখনোই আমাকে ওই চোখে দেখেনি ।
সেদিনের পর আর আমার সাথে ওর যোগাযোগ হয়নি। তারপর খালামনির কাছে একদিন শুনলাম ওনি ইমাদকে আবার বিয়ে দিয়েছেন। খুব কষ্ট হলো, ভাগ্যটা আমার এমন দেখে,,
কিন্তু সত্যি কথা বলতে মানুষটার জন্য আল্লাহপাক উওম একজন কেই পাঠিয়েছেন। হয়তো আমি ওর যোগ্য নয় তাই আমার কপালে ও আর এই জীবনে নেই।
.
.
.
---- এই যে ম্যাডাম কি ভাবছেন আপনি????
মায়া ভাবনার জগত থেকে বাস্তবতায় ফিরে --- অ্যা না কিছুনা এমনেই।
---ও,,, আচ্ছা তুমি ঘরে গিয়ে কিছুক্ষন বিশ্রাম নেও আসার পর তো আমার সাথে কেবল আড্ডাই দিয়ে গেলে এবার গিয়ে কতক্ষন বিশ্রাম নেও।
--- হুম আমি একটু ঘরে যাই।
মায়া চলে যেতেই নাজিফা নাবা নওরিনের দিকে চেয়ে-- এই যে মামুনিরা সুন্দর করে গিয়ে স্কুল ড্রেস পালটে ফ্রেশ হয়ে নেও,, স্কুল থেকে আসার পর তো এখন ও ড্রেস ও বদলাও নি দুজনে।
--- ওকে মা।
.
.
.
নাজিফা উপরে গিয়ে ঘরে ঢুকতেই দেখে ইমাদ বিছানায় শুয়ে আছে।
--- কি হলে জনাব??
--- না কিছুনা,, আমার একটা হেল্প করবে?? --- কি হেল্প??
--- মাথার একটু টিপে দিবে????
--- এখন!!!!
--- কেন কোনো সমস্যা??
--- না মানে কিছুক্ষন পর তো মা ডাকবে লান্চ করার জন্য।
--- ও মা ভীষণ যন্ত্রণা করছে দেখো।
--- আবার বাহানা করছো, ইদানিং তোমার সবকিছুতে এতো বাহানা কেন?? আর এতো নাটক করো কেন ইদানিং???
ইমাদ চুপ হয়ে গেলো,, নাজিফা বুঝে ফেলেছে আবার অভিমান করেছে।
নাজিফা ওর পাশে গিয়ে বসে আলতো করে ওর মাথাটাকে নিজের হাঁটুতে নিয়ে--- দুহাত দিয়ে ওর মাথা টিপতে--- টিপতে---এতো রাগ করা কিন্তু ভালো না।
---- রাগ তো যার তার সাথে করিনা নিজের বউয়ের সাথে করি।
--- হইছে, আচ্ছা মায়ার সাথে তোমার কি খুব ভালো সম্পর্ক???
--- একসময় ছিলো,, তারপর হঠাৎ তা নষ্ট হয়ে গেলো??
--- কেন??
---জানিনা।
---- কিন্তু মেয়েটি বেশ ভালো তাইনা?
--- হয়তো,,, তুমি ওর কথা বাদ দেওতো।।
--- মানে???
---- তুমি আমার কথা বলো, তোমার দশটা না পাঁচটা একটা মাত্র জামাই আমি,,,, কোথায় বাহির থেকে আসছি তুমি এখন শুধু আমার সাথে গল্প করবা,আঁচল দিয়ে আমার শরীর মুছে দিবা,,,
তা না মায়াকে নিয়ে পড়ে আছো।
--- ও আমার একটা জামাই আর সবার আট- দশটা তাইতো????
.
নাজিফা কই তুমি মা??? তাড়াতাড়ি নিচে আসো,,, কি দুপুরের ভাত কি খাবানা।
--- ওই দেখছো মা ডাকছে,,, তোমার জন্য দেরি হয়ে গেলো তাড়াতাড়ি নিচে চলো।
.
.
দুপুরের লান্চ করতে বসে,,,
ইমাদ খেতে-- খেতে ---- মা নিতু কোথায়??
মায়া তখন সালেহার দিকে তাকিয়ে--- ভালো কথা আসার পর থেকে তো নিতুর সাথে দেখাই হয়নি ও কই।
নাজিফা ক্ষীণ কন্ঠে --- ও বাড়ি নেই।
--- সেই যে সকালে বের হয়েছে এখনি ফিরেনি????
--- না,,, এই বলে নাজিফা নাবাকে খায়িয়ে দিতে- দিতে--- ইদানিং ও সকালে বের হয়ে যাচ্ছে আর রাত করে ফিরছে।
--- কি বলছো আগে বলোনি কেন আমায়???
---- আমি তোকে বলতে চেয়েছিলাম ইমাদ কিন্তু নাজিফা নিষেধ করেছে।
--- কিন্তু কেন???
--- কারন আমি ভেবেছিলাম হয়তো কোনো বান্ধবিদের বাসায় যায় পরে ঠিক হয়ে যাবে তোমাকে জানালে তোমার যে রাগ হযতো ওর সাথে খারাপ বিহেভ ও করতে পারো তাই। কিন্তু ইদানিং দেখছি এটা ওর অভ্যাসে পরিনত হয়ে গেছে।
---- মা আমি চাইনা ও এভাবে আর থাকুক, পড়াশুনা তো সেই কবেই ছেড়ে দিয়েছে,, অনেক হয়েছে আমার বন্ধু সোহান ওর ছোট ভাই আমেরিকা থেকে পড়াশুনা করে দেশে ফিরেছে এন্ড তুমি যদি অনুমতি দেও তাহলে আমি ওর সাথে কথা বলে দেখতে পারি।
---- আমার আবার অনুমতি আগে দেখ তোর এই অসভ্য বোনকে দেখতে আসতে তারা রাজি হয় কিনা।
অমনেই নিতু ঘরে ঢুকতে-- ঢুকতে--- আমার বিয়ে নিয়ে কথা বলছো অথচ আমার অনুমতি না নিয়ে!!!! আর কে অসভ্য??
( চলবে)
লিখা-- আসমা আক্তার পিংকি।


শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 coment rios: